Editor's Vids

আমাকে গালি দেওয়া হয় কারন আমি গার্মেন্টস শ্রমিক

আমি একজন গার্মেন্টস শ্রমিক। প্রতিদিন সকাল বেলা সূর্য ওঠার আগে আগের দিনের পান্তা খেয়ে কারখানায় আমার প্রবেশ। সকাল থেকেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে সুপারভাইজারের অবিরাম গালি খেয়ে কোনোরকমে কাজ করি। কি করব? পেট তো চালাতে হবে। দুপুরে খুব অল্প সময়ে বাসা থেকে নিয়ে আসা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবার খেয়ে আবার কাজে নেমে পড়তে হয়। প্রায় সবদিনই ওভার-টাইম করিয়ে নেয় আমাদের মালিকেরা। রাতে যখন বাড়িতে ফিরি তখন আর শরীর চলে না। কোনোরকমে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি কারণ সকাবেলা তো আবার সেই জীবন। সাত বছর ধরে কাজ করছি, এখনো চাকুরী নিশ্চয়তা বা এপয়েনমেন্ট কার্ড পাইনি। আমার চাকুরীর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সবসময় ভয়ে থাকি, সুপারভাইজারের অকথ্য গালিগুলো হজম করে যাই। কারণ চাকুরীটা চলে গেলে সংসার চালাবে কে। পড়াশুনা করা হয়নি, মাত্র ইন্টার পাশ। এই যোগ্যতায় অন্য কোথাও চাকুরী পাব বলে মনে হয় না। এর আগে একবার চাকুরী চলে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস বসে কাটাতে। এরপর থেকে চাকুরী নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি।

সবসময় সাবধানে থাকার চেষ্টা করি।
প্রায়ই দেখি কিছু শ্রমিক আলাদা হয়ে কি নিয়ে যেন কথা বলে। একজনকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম ওরা কি করে। ধমক দিয়ে বলেছিল "ওদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে চাকুরীটা হারাতে চাও। ওরা কমিউনিস্ট। মালিকের বিরোধী পক্ষ। খালি আন্দোলন করে বেড়ায়।ওদের সাথে মিললে চাকুরী যাবে নিশ্চিত। "

এরপর থেকে আমিও আর ওদের পথে পড়িনি আর কখনো। কে জানে কে কোথা থেকে মালিকপক্ষকে বলে দেবে। পরে চাকুরীটাও যাবে সাথে মুফতে মারও খেতে হবে। আমারই এক সহকর্মীকে একবার মার খেতে দেখেছিলাম ওর বেতন থেকে টাকা কেটে নেওয়ার প্রতিবাদ করেছিল, চাকুরীতো গেলই সাথে মালিকপক্ষের সন্ত্রাসীদের মার। উফফফ, সেকি মার। একটা কুকুরকেও মানুষ এভাবে মারতে পারে না। ওরা মারল। কেউ কোন প্রতিবাদও করেনি। আমি খুব ভীতু প্রকৃতির। আমিও কিছু বলিনি তখন। যদিও সে আমার খুব কাছের লোক ছিল। আমরা নিজেদের তরকারী ভাগাভাগি করতাম, তারপরও প্রতিবাদ করতে গিয়ে চাকরী হারানোর মানে হয় না ভেবে আমার আর প্রতিবাদ করা হয় না।

কয়েকমাস আগে নূন্যতম মজুরীর দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশের শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করছে রাস্তায়, তখনো আমি ঘরে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম কি হবে রাস্তায় নেমে, সরকার তো মালিকপক্ষের কথাই শুনবে, কখনো কি শুনেছে শ্রমিকদের কথা। শুধু শুধূ মার খাওয়ার কি কোনো মানে হয়। পুলিশ খুব জোড়ে মারে, হয়তো জানে এদেরকে এমনভাবেই শোষন করা হয় যে এই মারের প্রতিউত্তর দেয়ার শক্তি এদের নেই। খুব যে একটা ভুল ভাবে তাও না। মালিকপক্ষের দালাল শ্রমিকরা বাদে আমরা যারা সাধারণ শ্রমিক তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই পুলিশ আমাদের পেটায়, বুটের তলায় পিষ্ট করে, নারী শ্রমিকদের লাঞ্ছিত করে। আমরা কিছুই করিনা, কিছুই করার থাকেনা। বকেয়া বেতন আদায় করতে গিয়ে একবার আঙ্গুল ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই বকেয়া বেতন না দিলেও কিছু করার থাকে না। মুখ বুজে পড়ে থাকি। কেউ আন্দোলন করলে করুক আমি ভাই এর মধ্যে থাকি না সেই তখন থেকেই।

বলছিলাম নূন্যতম মজুরী আদায়ের সেই আন্দোলনের কথা। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সেই শ্রমিক আন্দোলনে প্রায় সব শ্রমিক অংশগ্রহন করে, আমার মত কিছু কাপুরুষ আর মালিকের দালাল, সরকা্রদলীয় শ্রমিক ছাড়া। সে সময় প্রচুর হাংগামা, কথা চালাচালি করে সে সময় নূন্যতম মজুরী নির্ধারণ হয় ৩০০০ টাকা। সরকারের সাজানো ৪২টা পকেট শ্রমিক সংগঠনকে দিয়ে এই মজুরী তারা পাশও করিয়ে নেয়। যদিও শ্রমিকদের দাবী ছিল ৫০০০ টাকা। তারাতো শ্রমিকদের দাবী মেনে নেয়নি ঊপর দিয়ে শ্রমিকদের নামে নেতাদের নামে মামলা করে দেয়। সে সময় শ্রমিকরা ভেবেছিল হোক না ৩০০০ টাকা তারপরও তো সামনে দু’টো ঈদ আছে, বেতন বোনাস মিলিয়ে আগের ধার-দেনা শোধ করা যাবে। যেদিন বেতন বাড়ানোর খবর দেখায় সেদিনই বাড়িওয়ালা নোটিশ পাঠায় বাড়িভাড়া বাড়ানোর। দোকানদার তাগাদা দেয় আগের বাকী পরিশোধের। সবাইকে হাসিমুখে হ্যাও বলি। কিন্তু পরদিন কারখানায় গিয়ে শুনতে পাই এখন বেতন বাড়ছে না। বেতন বাড়বে ডিসেম্বরে, শুনে মাথায় বাজ পড়ে। সন্ধ্যায় যখন বাড়িতে গিয়ে বাড়িওয়ালাকে বলি সে শুনতে নারাজ, এমনকি দোকানদারও।

এরপর আরো তিনমাস কেঁটে গেছে, মাঝখানে দু'টো ঈদ চলে গেছে। আমার ঘরে ঈদ হয়নি। আমার ছোট বোনের খুব শখ ছিল একটা শাড়ি কিনবে, দিতে পারিনি। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর আগে একবার আমাদের গ্রামটা দেখে আসবেন, যদিও সেখানে কিছুই নেই, নদী-ভাঙ্গনে ভিটেমাটি, জমির সাথে বাবার কবরটাও চলে গেছে অনেক আগেই। তারপরও মায়ের খুব ইচ্ছে একবার যাবেন। মাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। টাকায় কুলালো না। ভেবেছিলাম ডিসেম্বরে যাব মাকে নিয়ে।

গত শনিবার রাতে কারখানা থেকে ফিরতে ফিরতে জ্বর চলে আসে। এমাসের বেতন তখনো দেয়নি মালিকপক্ষ। এদিকে বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়ার জন্যে তাগাদা দেয়। কোনোরকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠাই।
রবিবার সকালে উঠে খবর পাই, আমাদের নাকি এমাসেও আগের কাঠামোতে বেতন দেবে মালিকেরা। শুনে রক্ত উঠে যায় মাথায়। একটা বাশ হাতে নিয়ে লুংগী পড়া অবস্থায় বেড়িয়ে পড়ি। আজকে যাকে সামনে পাব তারই খবর আছে। মালিকের দালাল কিংবা খোদ পুলিশ হোক। আজকে আর পিছু হটার রাস্তা নেই। পিছু হটার কোনো রাস্তা রাখেনি ওরা। ওরা আমাদের গাধা বানিয়ে আমাদের সামনে নূন্যতম মজুরীর মূলা ঝুলিয়েছে। আমাদের বারবার বোকা বানিয়ে ধোকা দিয়ে মুনাফার রক্তে গোসল করেছে এই পিশাচগুলো। আর তাদের রক্ষা করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। যাদের মধ্যে আছে এক সময়কার নামকরা শ্রমিক নেতারা। যাদের শিল্পমন্ত্রী একসময়কার আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতা, নামকরা বামনেতা। আজ কাউকে ছাড়ব না আমরা, সবাইকে জবাব দিতে হবে। কেন আমদের বোকা বানানো হল, কেন আমাদের ঘোরান হল, সবাইকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।

বাসা থেকে বেড়িয়ে সিইপিজেড এ ঢুকেই দেখি শ্রমিকের জনস্রোত। মিছিলের প্রবাহ এগিয়ে চলছে। সামনে যে বাধাই আসুক না কেন, আজকে তাদের রুখবার কেউ নেই। কোথায় পুলিশ, কোথায় মালিকের দালালেরা। কোথায় সরকারি শ্রমিক সংগঠন। কারোও কোনো অধিকার নেই, কোনো শক্তি নেই আজকে এই মিছিলের স্রোতকে ঠেকায়। মিছিলের স্রোত আরেক স্রোতের সাথে মিশে যায়, মিছিল ক্রমেই বড় হয়। এগিয়ে যায় অভিষ্ট লক্ষ্যে। এর মধ্যেই সামনে চিৎকার। টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে পুলিশ। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই আমরা। আস্তে আস্তে আবার যখন জড়ো হই তখন অন্য কোনো দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসে, গুলি করেছে পুলিশ, শ্রমিকদের মিছিলে গুলি করেছে পুলিশ, শেখ হাসিনার পুলিশ। দৌড়ে যাই সেদিকে, একটা মেয়ে পড়ে আছে, আমাদের কারখানারই মেয়ে বলে মনে হল নাম খুব সম্ভবত “রুহি”। কয়েকজন শ্রমিক ভাই গিয়ে বোনের লাশটা টেনে নিয়ে আসে।

এভাবে চলতে থাকে পুলিশে সাথে আমাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশ গুলি চালিয়ে নিহত করে আরো অনেককে। পুলিশ নিজেই বলেছে ওরা আমাদের ৪ জন ভাইকে হত্যা করেছে। আমি শুনেছি আরো বেশি, কেউ বলেছে ৭ কেউ বলেছে ১০ জন। র‍্যাব-পুলিশ এসে লাশগুলোকে টেনে-হিঁচরে পিকআপে তুলে নিয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আমি যেখানে থাকি সেই এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসেছিল, তখন দেখেছিলাম মৃত কুকুরগুলোকে ওদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। মনে পড়ে গেল সেই কথা। ওরা আমাদের কুকুর ভাবে। অন্তত শহীদ শ্রমিকদের লাশগুলো ওদের পরিবার পেতে পারত। দেশ কি আসলে স্বাধীন হয়েছে?

স্বাধীনতার আগে আন্দোলনকারীদের লাশ চুরি করত তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। স্বাধীনতার পরেও ন্যায্য বেতনের দাবীতে রাজপথে নামা শ্রমিকদের লাশ চুরি করল মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী শাসকেরা। শ্রমমন্ত্রী কথা বলেছে ওদের সাথে, আমাদের কেন ডাকল না? আমরা কি দেশের নাগরিক না? দেশটা কি কারো বাপের?

আমাদের কি দোষ? আমাদের যখন ওরা জানালো, “নতুন বেতন কাঠামোর প্রণয়নের শর্ত হিসেবে শ্রমিকদের সপ্তাহব্যাপী কাজ করার দক্ষতাসূচক উৎসাহ বোনাস, যাতায়ত ভাড়া, টিফিন খরচ সহ কয়েকটি খাতের টাকা আর দেয়া হবে না” তখন কি করে চুপ থাকি? যখন ওরা বলল, নতুন কাঠামোতে বেতন দেয়া হবে না, তখন কি করে চুপ থাকি? পত্রিকায় দেখলাম সরকার বলেছে একটি মহল ষড়যন্ত্র করে গার্মেন্টস শিল্প খাতকে ধ্বংস করার পায়তারা করছে। ওদের কেউ কেউ বলল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি মহল এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। কি কৌতুক !!!! এই যে হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায় নামল, এই যে ওরা আন্দোলন করল তা কিছুই না??? সব ষড়যন্ত্র !!! খুব হাসি পেয়েছিল সকালে খবরগুলো পড়তে পড়তে।

আমাদেরকে যে কুকুরের মত মারা হল তা ওদের পত্রিকায় গুরুত্ব পেল না। এমনভাবে খবর প্রকাশ হল যেন দোষটা আমাদের। যেন আমরা আমাদের রুজির দাবীতে রাস্তায় নেমে ভুল করেছি। হাসি পেয়েছিল খুব। হাসতে গেলে ঠোটে টান পড়ে, ব্যাথা করে খুব। গতকাল পুলিশ আমাকেও মেরেছে। লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে, বুট দিয়ে পিষেছে। অনেককে আবার ধরে নিয়ে লাইনে দাড় করিয়েছে পাকিস্তান আর্মি যেভাবে দাড় করিয়েছিল ১৯৭১ এ।

আমাদের যারা কুকুর ভাবো, কুকুরের মত গুলি করে মারার কথা ভাবছো তাদের জন্য বলছি, আমি শ্রমিক, আমি সর্বহারা। আমার তো হারাবার কিছু নেই, শুধু তোমাদের দেয়া শেকলটা ছাড়া। ইতিহাস আমার পক্ষে। তোমরা চিন্তা কর, তোমাদের মসনদ কিভাবে টিকিয়ে রাখবে। কারণ আমরা আসছি। তোমাদের রাষ্ট্রের সকল গুলি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের সংখ্যা শেষ হবে না। আমরা আসছি, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে, তোমরা তৈরী থাক।

বাইরে প্রচন্ড ধর-পাকড় হচ্ছে শুনেছি। মালিকপক্ষের মামলায় আসামী ধরতে এসেছে রাষ্ট্রের পুলিশ। আমাকেও ধরবে শুনেছি। গায়ে প্রচন্ড জ্বর, সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের কি খেতে দেয় মালিকপক্ষের জেল?

Related News

No comments:

Leave a Reply